কিছু নাম সংবাদ শিরোনামে আসে, পায় মানুষের সহানুভূতি ও সহায়তা। তবে কিছু আহত-নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদ কেবল থেকে যায় অদৃশ্য আড়ালে, বিস্মৃতির অতলে। তেমনি এক সাহসী তরুণ ইমরানুল হক রিয়াদ—যিনি আজ দৃষ্টিশক্তি হারানোর আশঙ্কায় চিকিৎসার জন্য লড়ছেন, আর পরিবার লড়ছে টিকে থাকার যুদ্ধ।
চট্টগ্রামের পটিয়ার কুসুমপুরা ইউনিয়নের উত্তর হরিণখাইন গ্রামের এই তরুণ বর্তমানে শহীদ এমএনজে কলেজের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সম্মুখযোদ্ধা রিয়াদ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট মোড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন।
ডান চোখে বিঁধে থাকা চারটি ছররা গুলির যন্ত্রণায় প্রতিটি দিন পার করছেন তিনি। বাম চোখে আংশিক দৃষ্টিশক্তি থাকলেও ডান চোখে আলো দেখা বন্ধ হয়ে গেছে। চিকিৎসকদের আশঙ্কা—উন্নত অস্ত্রোপচার না হলে তিনি চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারেন।
রিয়াদের পরিবার জানায়, ইতোমধ্যে সাত-আট লাখ টাকা ব্যয় করা হলেও তার চোখের অবস্থার উন্নতি হয়নি। চিকিৎসকদের মতে, চোখে জটিল অস্ত্রোপচারের জন্য প্রয়োজন অন্তত ১০ লাখ টাকা। এই ব্যয় বহন করার সামর্থ্য পরিবারটির নেই।
প্রবাসফেরত পিতা আহমদ নবী ও গৃহিণী শাহনাজ বেগমের বড় সন্তান রিয়াদ আগে টিউশন করে সংসারে সহায়তা করতেন। তবে চোখে আঘাত পাওয়ার পর থেকে সেটিও বন্ধ। ছোট ভাই রিজওয়ানুল হক বর্তমানে বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছেন। ফলে পুরো পরিবার মারাত্মক আর্থিক সংকটে রয়েছে।
চিকিৎসার শুরুতেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিয়াদের শরীর থেকে ৩৩টি স্প্লিন্টার অপসারণ করা হয়, কিন্তু চোখে আটকে থাকা ছয়টি স্প্লিন্টারের মধ্যে মাত্র দুটি বের করা সম্ভব হয়। এরপর তিনি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) এক মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন, কিন্তু সেখানেও চোখের বাকি স্প্লিন্টারগুলো অপসারণ সম্ভব হয়নি।
রিয়াদ বলেন, “চোখের অসহনীয় ব্যথায় অনেক রাত জেগে থাকতে হয়। ব্যথা মাথায় ছড়িয়ে পড়ে, ঘুমাতে পারি না, চোখ দিয়ে পানি ঝরে।”
তিনি আরও জানান, “আহতের প্রথম দিকে অনেকেই পাশে এসেছিলেন। এখন শুধু পরিবারই পাশে আছে। তবে আমি হাল ছাড়িনি। দেশের জন্য যদি প্রয়োজন হয়, বাকি চোখটিও দিতে প্রস্তুত আছি।”
আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “সেদিন (৫ আগস্ট) বহদ্দারহাট মোড়ে হঠাৎ চারদিক থেকে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডাররা অতর্কিতে গুলি চালায়। আমি সামনের সারিতে ছিলাম। চোখ, মুখ, মাথা ও শরীরে স্প্লিন্টার বিঁধে যায়।”
রিয়াদের মা শাহনাজ বেগম বলেন, “ছেলের চোখে এখনও চারটি ছররা গুলি রয়েছে। অস্ত্রোপচারে ৮-১০ লাখ টাকা দরকার, যা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা সরকারের সহানুভূতিশীল সহযোগিতা চাই।”
তিনি অভিযোগ করেন, “আন্দোলনে আহত অন্যদের চিকিৎসা সরকার বহন করলেও আমাদের সন্তানের ক্ষেত্রে তা হয়নি। আমাদের সন্তান দেশের জন্য লড়েছে, এখন তার চিকিৎসার দায় রাষ্ট্রের নেওয়া উচিত।”
রিয়াদ শেষ কথায় বলেন, “চোখ হারিয়েছি হয়তো, কিন্তু স্বপ্ন হারাইনি। এই ত্যাগ যেন নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে কাজে আসে—এই আশাই আমার প্রাপ্তি।”
Leave a Reply