বিগত সময়ে পুঁজিবাজারে সক্রিয় একটি গোষ্ঠী শেয়ারবাজারে কৃত্রিম ওঠানামার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। তাদের সাজানো কারসাজির ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন বহু সাধারণ বিনিয়োগকারী। এসব ঘটনায় তৎকালীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কার্যত কোনো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি; বরং দায়সারা তদন্ত ও নামমাত্র জরিমানাতেই সীমাবদ্ধ ছিল তাদের কার্যক্রম।
ইউরোপীয় কায়দায় কাঁকড়া চাষ রপ্তানি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায়
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্যান্য খাতের মতো বিএসইসিতেও আসে পরিবর্তন। নতুন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। দায়িত্ব নিয়েই তিনি অতীতের বড় বড় শেয়ারবাজার কারসাজির ঘটনা খতিয়ে দেখা শুরু করেন এবং বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে শুরু করেন ব্যাপক জরিমানা কার্যক্রম।
বেক্সিমকো, ওরিয়ন ফার্মা, ওরিয়ন ইনফিউশনসহ বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গৃহীত হয় নজিরবিহীন জরিমানা, যার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার ৩৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। দেশের পুঁজিবাজার ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ জরিমানার রেকর্ড। কিন্তু বিএসইসি জানিয়েছে, গত ৯ মাসে এই বিপুল অঙ্কের জরিমানার এক টাকাও আদায় করা সম্ভব হয়নি।
বিএসইসি জানায়, আইনি ও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণেই জরিমানা আদায় করা যাচ্ছে না। কমিশন সূত্র জানায়, কারসাজির প্রমাণ পাওয়ার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অভিযুক্তদের কাছে জরিমানা আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযুক্তরা তাদের আইনি অধিকার অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে রিভিশন এবং ১৮০ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে পারেন। কেউ চাইলে জরিমানার ১৫ শতাংশ জমা দিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করতেও পারেন। এসব আইনি প্রক্রিয়া চলাকালীন জরিমানা আদায় করা যায় না।
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন,
‘জরিমানার পর সরাসরি টাকা আদায়ের সুযোগ আমাদের নেই। আইন অনুযায়ী রিভিশন ও রিভিউর সুযোগ থাকায় সেই সময়সীমা পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। কেউ রিট করলে সেটির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জরিমানা আদায়ও সম্ভব হয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যদি কোনো আবেদন না করে, তাহলে নির্ধারিত সময় পার হলে পিডিআর অ্যাক্ট অনুযায়ী সার্টিফিকেট মামলা করা হয় এবং আদালতের মাধ্যমে ওয়ারেন্ট জারি করে অভিযুক্তকে হাজির করা যায়। তবে জরিমানার সিদ্ধান্ত মানেই তাৎক্ষণিক আদায়—এমন কোনো বিধান আমাদের আইনে নেই।’
জরিমানার অঙ্কের দিক থেকে সবচেয়ে শীর্ষে রয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেড—চার ব্যক্তি ও পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে মোট ৪২৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছে:
ইমাম বাটন: ১ কোটি টাকা
কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স: ২০ লাখ টাকা
প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স: ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা
সোনালী পেপার: ৬০ লাখ টাকা
বে-লিজিং: ১৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা
হিরু ও তার পরিবার/প্রতিষ্ঠান: ১৩৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা
ফাইন ফুডস: ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা
আমিনুল-হিরু চক্র: ১০ কোটি ১৩ লাখ টাকা
বাংলাদেশ ফাইন্যান্স, জেনারেল ইনস্যুরেন্স ও আনোয়ার গ্যালভানাইজিং: ১৩৪ কোটি টাকা
খান ব্রাদার্স: ৮৬ লাখ টাকা
সাকিব-হিরু: ৩১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা
ওরিয়ন ইনফিউশন: ৫৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা
হিরু-সাদিয়া: ১৯ কোটি টাকা
সি পার্ল বিচ রিসোর্ট ও সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স: ১৯০ কোটি টাকা
জেমিনি সি ফুড: ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা
আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ (রাভী হাফিজ): ১৫ কোটি টাকা
সাকিব-হিরু (আরও): ২ কোটি ১৮ লাখ টাকা
অর্থনীতিবিদ ড. আবু আহমেদ বলেন,
‘আগে লোক দেখানো জরিমানা হতো। এখন প্রকৃত কারসাজি অনুযায়ী জরিমানা হচ্ছে—এটা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে জরিমানা করা সহজ হলেও আদায় করা অত্যন্ত কঠিন। আদায়ের কার্যকর উদাহরণ খুব কমই আছে।’
একটি সিকিউরিটিজ হাউসের প্রধান নির্বাহী বলেন,
‘বিদ্যমান আইন দিয়ে এই জরিমানা আদায় সম্ভব নয়। কারা সার্কুলার ট্রেডিং বা ফ্রন্টলাইন ট্রেডিং করছে, সেই তথ্য বিএসইসির কাছে রয়েছে। এখন দরকার যথাযথ আইনি সংস্কার ও কঠোর প্রয়োগ।’
পর্যায়ক্রমে নৌ-রুটে যুক্ত হবে ৬টি নতুন ফেরি:নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা
আইনের দীর্ঘসূত্রতা, ফাঁকফোকর আর বাস্তবায়নের অভাবে পুঁজিবাজারে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাচ্ছেন, আর শাস্তি এড়িয়ে বারবার পুনরাবৃত্ত হচ্ছে একই ধরনের অপরাধ। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জরুরি আইনি সংস্কার, শক্তিশালী প্রয়োগ ব্যবস্থা এবং দ্রুত কার্যকর বিচারপ্রক্রিয়া।
Leave a Reply