
নদী,খাল আর বিস্তীর্ণ সবুজের মাঝখানে গড়ে ওঠা মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলা যেন ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক জীবন্ত দলিল। খোঁজ নিলে জানা যায়, বহু শতাব্দী আগেই এখানে গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ জনপদ। মুখে মুখে চলে আসা কাহিনির সঙ্গে ইতিহাসের পাতাও মিল রেখে বলে দেয়—সাটুরিয়া কেবল একটি প্রশাসনিক এলাকা নয়, এটি এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিকাশের সাক্ষী।
‘সাটুরিয়া’ নামটি নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত। প্রবীণরা বলেন, একসময় এখানে ‘সাটু’ নামের এক হিন্দু জমিদার বসবাস করতেন। তার নামানুসারেই জায়গাটির নাম হয় ‘সাটুরিয়া’। আবার কেউ বলেন, ‘সাঁটিয়া’ বা ‘সাঁতারিয়া’ নাম থেকেই এসেছে সাটুরিয়া—যার মানে, যে স্থানে লোকেরা নৌকা বা সাঁতারে নদী পার হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারণের পরিবর্তনে নাম হয় ‘সাটুরিয়া’।
তবে স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, ব্রিটিশ শাসনামলের সময় মানিকগঞ্জ মহকুমার অংশ হিসেবে প্রশাসনিক প্রয়োজনেই ‘সাটুরিয়া’ নামটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৩ সালে উপজেলা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু হলে সাটুরিয়াকে পূর্ণাঙ্গ উপজেলা ঘোষণা করা হয়।
পুরনো মানুষজন বলেন, শত বছর আগেও এখানে প্রতি সপ্তাহে হতো বড়সড় হাট। স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় ‘বালিয়াটি হাট’, ‘ধলেশ্বরী হাট’, কিংবা ‘বালাইনগর বাজার’ কেবল বেচাকেনার জায়গা ছিল না, ছিল যোগাযোগ ও সমাজিক মেলবন্ধনের কেন্দ্রও। বিশেষ করে ধলেশ্বরী নদীর আশপাশে গড়ে উঠা জনবসতি ছিল নানা সম্প্রদায়ের মানুষের মিলনমেলা।
সাটুরিয়ার ইতিহাস বললে যে নামটি না বললেই নয়, সেটি হচ্ছে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নির্মিত এই জমিদার প্রাসাদ ছিল স্থানীয় রায় চৌধুরী পরিবারের বসতবাড়ি। ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই প্রাসাদটি আজো দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন অতীতের এক স্মারক হিসেবে। পর্যটকদের কাছে এটি আকর্ষণীয় স্থান হলেও, স্থানীয়দের কাছে এটি গর্ব ও নস্টালজিয়ার প্রতীক।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সাটুরিয়ার মানুষও দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে। জানা যায়, সাটুরিয়ায় বেশ কয়েকটি গ্রামে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ হয়। এই অঞ্চলের অনেক তরুণ-যুবক জীবন দিয়েছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। আজো কিছু গণকবর এবং স্মৃতিফলক সেই রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
সাটুরিয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশও এই জনপদের ইতিহাসে প্রভাব রেখেছে। একসময় ঘন বনভূমিতে ঘেরা ছিল এর বড় একটি অংশ। ধলেশ্বরী নদী, খাল-বিল আর শস্যভরা মাঠ মিলে এখানে গড়ে উঠেছিল কৃষিনির্ভর এক গাঁথুনি। কালের পরিক্রমায় বন কমেছে, নদীও অনেক জায়গায় শুকিয়ে গেছে, কিন্তু মানুষ এখনও নদীমাতৃক ঐতিহ্য বুকে ধারণ করেই এগিয়ে চলেছে।
সাটুরিয়া শুধু মানিকগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা নয়, এটি ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে নিজেকে রেখেছে আলাদা মর্যাদায়। এই জনপদের গল্প বললে উঠে আসে জমিদারদের রাজকীয়তা, কৃষকের ঘাম, নদীর কোলঘেঁষা জনজীবন এবং সংগ্রামী মানুষের আত্মত্যাগ। আদি সেই কথাগুলো স্মৃতির মতোই রয়ে গেছে, হয়তো কিছুটা ঝাপসা, কিন্তু মুছে যায়নি।
Leave a Reply