মধ্যপ্রাচ্যে আবারও উত্তাল হয়ে উঠেছে কূটনৈতিক অঙ্গন। ফিলিস্তিন, লেবানন, ইয়েমেন ও সিরিয়ার পর এবার ইরান হয়ে উঠেছে ইসরায়েলের নতুন লক্ষ্য। সম্প্রতি ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় চালানো একাধিক হামলা শুধু একটি দেশের ওপর আঘাত নয়, বরং গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
ইরানে ইসরায়েলের হামলা, যুদ্ধকালীন ক্ষমতা ছাড়লেন আয়াতুল্লাহ খামেনি
ইসরায়েল দাবি করছে, এটি তাদের ‘নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ’। তারা বারবার বলে আসছে—ইরান খুব শিগগিরই পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই হুঁশিয়ারি কি বাস্তব, নাকি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ?
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত তিন দশক ধরেই বলে আসছেন—ইরান কয়েক মাস বা বছরের মধ্যেই পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলবে। কিন্তু এত বছরেও সেই বোমার অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ মেলেনি। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) কিংবা জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণেও এমন কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি ইসরায়েলের হামলার জবাবে ইরানও পাল্টা আঘাত হেনেছে, যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই উত্তেজনা কেবল ইরান-ইসরায়েলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো অঞ্চলে।
এরই মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে ইসরায়েলের সাবেক উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী মেইর মাসরির এক বক্তব্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ তিনি বলেন, “ইরানের পর এবার আমাদের লক্ষ্য পাকিস্তান। তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করা হতে পারে।” তাঁর এই মন্তব্য শুধু পাকিস্তানের জন্য নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্যই একপ্রকার মৌন হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইসরায়েলের এই অবস্থান একপাক্ষিক। কারণ, ইসরায়েল নিজেই একটি গোপন ও সুসংগঠিত পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে, যার অস্তিত্ব সর্বজনবিদিত হলেও তারা কখনো তা স্বীকার বা অস্বীকার করেনি—এ যেন ‘সবার জানা গোপন সত্য’।
আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউট ও স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের হাতে বর্তমানে প্রায় ৯০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ৩০০টিরও বেশি তেজস্ক্রিয় উপাদান, যা দিয়ে অস্ত্র তৈরি সম্ভব।
ইসরায়েল ১৯৫৮ সালেই ডিমোনা-তে গোপন পারমাণবিক প্রকল্প শুরু করে। ধারণা করা হয়, ১৯৬৬-৬৭ সালেই তারা প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে এবং ১৯৭৯ সালে গোপনে বায়ুমণ্ডলীয় পরীক্ষা চালায়, যদিও এ বিষয়টি অস্বীকার করা হয়।
এছাড়া ইসরায়েল এখনো পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (NPT)-তে স্বাক্ষর করেনি এবং তারা মধ্যপ্রাচ্যে গণবিধ্বংসী অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল গঠনের উদ্যোগেরও বিরোধিতা করে আসছে। অথচ একই সঙ্গে তারা জাতিসংঘে অন্য রাষ্ট্রকে চুক্তিতে আনতে নিয়মিত আহ্বান জানায়।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের কৌশল অত্যন্ত সুস্পষ্ট—তারা মধ্যপ্রাচ্যে একক পারমাণবিক ক্ষমতার অধিকারী শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে চায়। এজন্য তারা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সামরিক বা পারমাণবিক সক্ষমতা দমিয়ে রাখতে চায়। ইরানকে ঠেকানোর চেষ্টা, এবং এখন পাকিস্তানকে হুমকি দেওয়াও সেই পরিকল্পনারই অংশ।
সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দাঁড়াল ইউরোপের ৯ দেশ
ইসরায়েলের এই দ্বিচারিতা শুধু আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেই নয়, বরং বৈশ্বিক সমতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত—ইরান বা পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি ইসরায়েলের গোপন পারমাণবিক কর্মসূচির ওপরও নিরপেক্ষ তদন্ত ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। অন্যথায় বিশ্ব আবারও ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’-এর ফাঁদে পড়ে বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।
Leave a Reply