জরিনা বেওয়ার চোখের কোণ ভেজা। কথার ফাঁকে কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, “এইখানে আমার দাদার ভিটা ছিল, আব্বা এইখানেই ফসল ফলাইতেন। সব যমুনা খাইয়া গেল।”
মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার বাঘুটিয়া এলাকায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন তিনি। চারপাশে কেবল গর্ত আর ধ্বংসস্তূপ। একটু দূরেই ক্ষিপ্র যমুনা সোঁ সোঁ করে বইছে।
এ জেলার বুকজুড়ে ছড়িয়ে আছে পদ্মা, যমুনা, ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা, ইছামতি আর গাজীখালী নদী। এই নদীগুলো একদিকে যেমন জীবিকার পথ, অন্যদিকে তেমনি দুর্যোগের নাম। বিশেষ করে বর্ষা এলেই ভয়াল রূপ নেয় নদীগুলো। শুরু হয় ভাঙনের মৌসুম।
যমুনার সঙ্গে লড়াই
পানি বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে তীরের মাটি গলে গলে পড়ছে নদীতে। গত কয়েক সপ্তাহে দৌলতপুর, হরিরামপুর, সিংগাইর, শিবালয়, সাটুরিয়া, ঘিওর ও মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার অর্ধশতাধিক এলাকা ভাঙনের কবলে পড়েছে।
সুলতানা বেগম বলেন, “আমার ঘর দুইদিনেই যমুনা নিয়া গেছে। পোলাপাইন লইয়া আত্মীয়ের বাড়ি উঠছি। কতদিন থাকুম, জানি না। জমিও নাই, কাজও নাই।”
স্থানীয়রা জানান, শুধু বসতঘর না, মসজিদ, স্কুল, হাট-বাজারও হারিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে।
ভাঙনের মুখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আশ্রয়ণ প্রকল্প
শিবালয়ের গঙ্গাপ্রসাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একপাশে নদী। একটু বৃষ্টি হলেই আতঙ্কে কাঁপে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আর একটু ভাঙলেই স্কুল নদীতে হারিয়ে যাবে।
দৌলতপুরের লাউতাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পও এখন ভাঙনের মুখে। কয়েকটি পরিবার ইতোমধ্যে অন্যত্র চলে গেছে।
চলছে জিও ব্যাগ, থামছে না নদী
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, জেলার ৬৪টি স্থান ভাঙনের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেন, “ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জরুরি প্রতিরক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। তবে স্থায়ী প্রতিরক্ষার জন্য প্রকল্প প্রণয়ন ও ফিজিবিলিটি স্টাডি চলছে।”
কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। প্রতিবছর জিও ব্যাগ ফেলা হয়, কিছুদিন টিকে থাকে, তারপর আবার ভাঙন শুরু হয়।
আরিচার নেহালপুল এলাকার বাসিন্দারা বলেন, “ঘরবাড়ি, মসজিদ-মাদরাসা, জমি যমুনায় বিলীন হয়। আমরা চাই স্থায়ী বাঁধ। এভাবে কত বছর বাঁচা যায়?”
একটুকু ঠাঁই চাই
ভাঙনে ঘরহারা মানুষগুলোর চাওয়া খুব বেশি নয়—একটুকু আশ্রয়, একটু নিরাপদ জায়গা, আর একটু স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ।
তারা আর নদীর তীরে ঘর তুলতে চায় না, চায় স্থায়ী বাঁধ। চায় বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা।
মানিকগঞ্জের নদীভাঙন যেন শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি এক নিঃশব্দ মানবিক বিপর্যয়। যেখানে প্রতিদিন মানুষ হারাচ্ছে তাদের জীবনভিত্তি, স্মৃতি, আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
সরকারি আশ্বাস, কিন্তু সময় কোথায়?
প্রতিবছর বরাদ্দ আসে, প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন কবে? ততদিনে তো হয়তো আরও শতাধিক পরিবার নদীতে ভেসে যাবে।
এখনই যদি স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তবে মানিকগঞ্জের নদীতীরবর্তী জনপদগুলো শুধু মানচিত্র থেকেই নয়, ইতিহাস থেকেও হারিয়ে যাবে।
Leave a Reply