গান — মানব সভ্যতার এক অমোঘ সৃষ্টি, যা যুগে যুগে মানুষের আবেগ, ভাবনা ও সংস্কৃতিকে বহন করে চলেছে সুর আর ছন্দের রূপে। পৃথিবীর যত শিল্প, তার মধ্যে গান সবচেয়ে পুরাতন ও বহুমাত্রিক এক প্রকাশভঙ্গি। তবে গানের উৎপত্তি ঠিক কখন, কোথায় — তার সুনির্দিষ্ট ইতিহাস নেই, বরং এর শিকড় ছড়িয়ে আছে প্রাগৈতিহাসিক কালে।
পুঞ্জিলাল মেহেরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
আদিম মানব ও গানের জন্ম
গবেষকরা মনে করেন, গানের উৎপত্তি আদিম মানুষের মৌলিক প্রয়োজন থেকে। ভাষা আবিষ্কারের আগেই মানুষ ছন্দ, শব্দ ও ধ্বনির সাহায্যে ভাব প্রকাশ করত। কাজেই গান ছিল একপ্রকার যোগাযোগের মাধ্যম — কখনও সুখের প্রকাশ, কখনও কষ্টের কান্না, আবার কখনও সমাজের সামূহিকতা ধরে রাখার চেষ্টা। শিকার করতে যাওয়ার আগে যুদ্ধের মন্ত্রোচ্চারণ, বা রাতে আগুনের পাশে বসে গাওয়া কোনো ছন্দময় ধ্বনি — এভাবেই গানের প্রাথমিক রূপ গড়ে উঠেছিল।
ধর্ম, রীতি ও লোকাচারে গানের বিকাশ
যতই সভ্যতা গড়ে উঠেছে, গান পেয়েছে নির্দিষ্ট রূপ। প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে যেমন মিশর, ব্যাবিলন, ভারত, চীন — সবখানেই ধর্মীয় আচার ও রীতির সঙ্গে গান ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বৈদিক যুগে ‘সামগান’ ছিল হিন্দুধর্মের অন্যতম গীতধর্মী স্তোত্র। আবার গ্রিক নাট্যশালায় গান ও সংগীত ছিল নাটকের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
লোকগান বা ফোক মিউজিক এসেছে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ছড়ানো গল্প, কষ্ট ও জীবনের কথা থেকে। এটি ছিল শ্রুতিনির্ভর — কোনো লিখিত সুর বা স্কোর ছিল না, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রচিত হতো মৌখিক ভাবে। বাংলা অঞ্চলে যেমন ‘ভাটিয়ালি’, ‘বাউল’, ‘ভাওয়াইয়া’, ‘জারি-সরীফ’ — এ সবই লোকসংস্কৃতির অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
সুর থেকে সংগীতের বিবর্তন
গানের জগতে সবচেয়ে বড় বিপ্লব আসে যখন তাত্ত্বিক সংগীতচর্চা শুরু হয়। গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাস সুরের কম্পাঙ্ক বিশ্লেষণ করে সঙ্গীতের গাণিতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে মধ্যযুগে ইউরোপে চার্চ সংগীত ও ভারতীয় উপমহাদেশে ধ্রুপদ-ধামার ধারা গঠিত হয়।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গানের নবজন্ম
বিশ্বব্যাপী শিল্পবিপ্লবের পরে যখন ছাপাখানা ও রেকর্ডিং প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হলো, তখন গান নতুন মাত্রা পায়। একদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গানে যোগ করেন সাহিত্য ও দার্শনিকতা, অন্যদিকে পাশ্চাত্যে জন্ম নেয় অপেরা ও সিম্ফোনির ধারায় নতুন ধ্বনিবিশ্ব। ২০শ শতকে রেডিও, সিনেমা ও পরবর্তীকালে ইন্টারনেট — গানকে পৌঁছে দেয় প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে।
গান আজ কী?
গান এখন শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি প্রতিবাদ, প্রেম, স্মৃতি, ইতিহাস — সবকিছুরই প্রতিচ্ছবি। এটি মানুষের আবেগের ভাষা, যা কোনো একক সংস্কৃতি বা সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
যদিও গানের উৎস খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হয় সময়ের কুয়াশায় মোড়ানো প্রাচীন পৃথিবীতে, তবু বলা যায় — গান এমন এক ধ্বনি-স্মৃতি, যা মানুষের জন্মলগ্ন থেকেই তার সঙ্গী।
Leave a Reply